আত্মত্যাগের আলোয় ঈদুল আজহা

ঈদুল আজহা—মুসলিম উম্মাহর জন্য এক পবিত্র ও তাৎপর্যময় দিবস, যেটি কেবল উৎসবের রঙিন আভা নয়, বরং হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত হয় আত্মত্যাগ, আনুগত্য ও বিশ্বাসের নিঃশর্ত অঙ্গীকারে। ইসলামের এই মহান উৎসবের সূচনা ইতিহাসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত—হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগের কাহিনি থেকে।
আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে স্বপ্নে আদেশ দেওয়া হয় তাঁর প্রিয় পুত্রকে কুরবানি করার, তখন তিনি এক মুহূর্তের জন্যও দ্বিধান্বিত হননি। আর ইসমাইল (আ.)-এর মুখেও ছিল অবিচল শান্তি ও সম্মতি—“হে পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা-ই করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।” (সূরা ছাফফাত: ১০২)
এই চরম পরীক্ষা ছিল আনুগত্য ও ঈমানের এক মহান পর্ব। আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রিয় পুত্রকে উৎসর্গ করতে উদ্যত হওয়াই ছিল প্রকৃত ত্যাগ। আল্লাহ তাআলা এই আত্মনিবেদন ও আনুগত্যের উত্তম পুরস্কারস্বরূপ ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি পশু প্রেরণ করেন, যা কুরবানি করার নির্দেশ দেন। এই ঘটনাই মুসলিম জগতে কুরবানির প্রথার সূচনা করে এবং তা আজও প্রতিবছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আজহার মাধ্যমে উদযাপিত হয়।
এই ঈদ কেবল পশু জবাইয়ের উৎসব নয়; বরং তা এক আত্মশুদ্ধির আহ্বান। কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, “আল্লাহর কাছে তাদের গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, বরং পৌঁছে তাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ্জ: ৩৭)
ঈদুল আজহার মূল শিক্ষা হলো—আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাদের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটিও ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকা। আজকের দিনে সেই আত্মত্যাগের চেতনা কেবল পশু কুরবানির মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়; বরং আমাদের উচিত নিজের অহংকার, লোভ, হিংসা ও গর্বের মতো আত্মিক পশু কুরবানি করে ঈমানদারিত্বের পরিচয় দেওয়া।
এ ঈদ আমাদের শেখায় দান, সহানুভূতি ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মূল্য। কুরবানির মাংস তিন ভাগ করে বিতরণ করা—এক অংশ নিজের জন্য, এক অংশ আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর জন্য এবং এক অংশ দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য—এই নিয়মে সমাজে ন্যায়ের বণ্টন ও ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এতে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ লাঘব হয় এবং সৃষ্টি হয় এক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ।
ঈদুল আজহার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো জামাআতের সাথে ঈদের নামাজ ও একে অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ভাইচারা প্রতিষ্ঠা করা। এ উৎসব মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের বার্তা বহন করে এবং ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটায়।
আজকের সমাজে যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, ভোগবাদ এবং আত্মঅহমিকার বিস্তার ঘটছে, সেখানে ঈদুল আজহার শিক্ষাই হতে পারে নৈতিক সংস্কারের ভিত্তি। এই ঈদের শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, আত্মত্যাগের মানসিকতা এবং মানবতার কল্যাণে আত্মনিবেদনই ইসলামী জীবনের মূল ভিত্তি।
আসুন, আমরা ঈদুল আজহার এই পবিত্র দিনে নিজেদের অন্তর থেকে অহংকার, হিংসা ও লোভ কুরবানি করি, সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি ও ন্যায়ের আলো ছড়িয়ে দিই এবং হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগের আদর্শে আমাদের জীবনকে পরিচালিত করি।

























