মহিমান্বিত শুক্রবার

শিব্বীর বিন রশীদ
শুক্রবার— বিশ্ব মুসলিম উম্মাহের জন্য সাপ্তাহিক ঈদের দিন। তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব আদৌ কেউ অস্বীকার করতে পারেনি, পারবেও না। কেননা শুক্রবার তো আল্লাহর তরফ থেকেই মর্যাদাবান। এ কারণেই হয়তো এই দিনে সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্দ থাকে! তবে তা কেন? কারণ আল্লাহ বলেন.
فسعوا إلى ذكر الله و ذروا البيع ،
আল্লাহ দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের হৃদয়ে ঢেলে দেন একথাটি। তাই তাদের অজান্তেই তারা এই দিনে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করে। এ ছুটি স্বীকৃতি দেয় এ কথার যে, মুসলিমদের সবকিছুই সঠিক। কিন্তু আমরা মুসলিমরা কত সৌভাগ্যবান জানেন? আমাদের ইবাদাতগাহ মাসজিদ এই দিনে খোলা থাকে। তাও আবার নাসীহা শুনার সুযোগ সবসময় না হলেও এইদিনে আমাদের হয়।
এই সাপ্তাহিক ঈদ সকল ঈদের চেয়ে ভিন্ন। তা বয়ে আনে রহমানের পক্ষ থেকে রহমতের বারিধারা। এই দিনে লক্ষ কোটি ফেরেশতা জমিনে অবতরণ করেন। এই দিনে রাসুলের(ﷺ) দরবারে দরুদ পোঁছানো হয়। এই দিনে ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলেই আসে একতার বন্ধনে বন্দি হয়ে জুমার ফরজ সালাত আদায় করতে ।
কুরআন প্রেমীরা এই দিনে ‘সূরা কাহাফ’ তেলাওয়াত করে। সূরা কাহাফের ফজিলত অনেক। যেমন—
১. যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা আল কাহাফ পড়বে, তার (ঈমানের) নূর এই জুমা থেকে আগামী জুমা পর্যন্ত চমকাতে থাকবে। (মিশকাত ২১৭৫)।
২. যে ব্যক্তি সূরা কাহাফ এর প্রথম দশটি আয়াত মুখস্থ করবে তাকে দাজ্জালের অনিষ্ট হতে নিরাপদ রাখা হবে। (সহিহ মুসলিম)
৩. ‘যে ব্যক্তি সূরা কাহাফ পাঠ করবে, কিয়ামতের দিন তা তার জন্য এমন একটি নূর হবে, যা তার অবস্থানের জায়গা থেকে মক্কা পর্যন্ত আলোকিত করে দিবে। আর যে ব্যক্তি উহার শেষ দশটি আয়াত পাঠ করবে, তার জীবদ্দশায় দাজ্জাল বের হলেও সে তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (সিলসিলায়ে সহীহা -২৬৫১)।
৪. যে ব্যক্তি জুমার রাত্রিতে সূরা কাহাফ পাঠ করবে, তার জন্য স্বীয় অবস্থানের জায়গা থেকে পবিত্র মক্কা পর্যন্ত একটি নূর হবে।’ (আত তারগীব ওয়াত্ তারহীব – ৭৩৬)।
৫. জুমার দিনে সূরা কাহফ পাঠ করলে কিয়ামত দিবসে তার পায়ের নীচ থেকে আকাশের মেঘমালা পর্যন্ত নূর আলোকিত হবে এবং দুই জুমার মধ্যবর্তী গুনাহ মাফ হবে। (আত তারগীব ওয়াল তারহীব- ১/২৯৮)
৬. জনৈক ব্যক্তি সূরাহ আল কাহফ পড়ছিল। সহসাই তাকিয়ে দেখতে পেল একখণ্ড মেঘ তাকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে।হযরত বারা ইবনু আযিব বর্ণনা করেছেন যে, লোকটি বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম এর কাছে বললে তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে অমুক! তুমি (কাহাফ)সূরাটি পড়তে থাক। কারণ এটি ছিল আল্লাহর রহমত বা প্রশান্তি, যা কোরআন তেলাওয়াতের কারণে বা কোরআন তেলাওয়াতের জন্য অবতীর্ণ হয়েছিল। (মুসলিম- ১৭৪২)।
অর্থাৎ এটা হলো আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ওই ‘সাকীনা’ প্রশান্তি যা কোরআন পাঠের সময় অবতীর্ণ হয়ে থাকে।
এই সুরার প্রথম দশটি আয়াত সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,যে এগুলো মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে বেঁচে যাবে। (মুসলিম)
এছাড়া সাড়ে চৌদ্দশত বছরের দ্বারপ্রান্তে এসেও যদি এই উম্মতের কেউ রাসুল ﷺ এর ওপর দরুদ পাঠকারে তাহলে তার পক্ষ থেকে সে দুরুদ ও সালাম রাসুলের রওজায় পৌঁছানো হয়।
রাসুলের উপর দরুদ পড়ার অনেক ফজিলত রয়েছে।
কতিপয় নিম্নে তুলে ধরছি— নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ পাঠান। হে মুমিনগণ! তোমরাও তার প্রতি দরূদ পাঠাও এবং অধিক পরিমাণে সালাম পাঠাও। (সূরা আহযাব ৫৬ আয়াত)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’স রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, “যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ এর দরুন তার ওপর দশটি রহমত বর্ষণ করবেন।” (মুসলিম)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি সব লোকের চাইতে আমার বেশী নিকটবর্তী হবে, যে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আমার উপর দরূদ পড়বে।” (তিরমিযী)
অন্য হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের দিনগুলির মধ্যে সর্বোত্তম দিন হচ্ছে জুমুআর দিন। সুতরাং ঐ দিন তোমরা আমার উপর অধিকমাত্রায় দরূদ পড়। কেননা, তোমাদের দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়।” লোকেরা বলল, ’ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি তো (মারা যাওয়ার পর) পচে-গলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের দরূদ কিভাবে আপনার কাছে পেশ করা হবে?’ তিনি বললেন, “আল্লাহ পয়গম্বরদের দেহসমূহকে খেয়ে ফেলা মাটির উপর হারাম করে দিয়েছেন।” (বিধায় তাঁদের শরীর আবহমান কাল ধরে অক্ষত থাকবে)। (আবু দাউদ)।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই অভিশাপ দিলেন যে, “সেই ব্যক্তির নাক ধূলোয় ধূসরিত হোক, যার কাছে আমার নাম উল্লেখ করা হল, অথচ সে (আমার নাম শুনেও) আমার প্রতি দরূদ পড়ল না।” (অর্থাৎ ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ বলল না।) (তিরমিযী।
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “প্রকৃত কৃপণ সেই ব্যক্তি, যার কাছে আমি উল্লিখিত হলাম ( অর্থাৎ,আমার নাম উচ্চারণ করা হল), অথচ সে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করল না।” (তিরমিযী, হাসান সহীহ)।
এই দিনটিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আশিকীনদের জবানে প্রচুর পরিমাণে দুরুদ গুঞ্জরিত হতে থাকে। দ্বীনি মহলে দুরুদ পাঠের এই জোয়ার কঠিন হৃদয়কে বিগলিত করে দেয়। মুসলিমদের বেচায়ান হৃৎপিণ্ড চায় বারবার ঘুরে ফিরে আসুক শুক্রবার
আসুন, রাসুলের শানে দুরুদ পড়ে নিজেকে করি পরিশুদ্ধ। মনমিনারে ঢেউ খেলুক ইশক্বে নাবির সুর। স্বীয় আত্মাকে সৌভাগ্যবানদের কাতারে শামিল আসুন রবের দিকে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেখানো পথে। পড়তে থাকুন— সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
লেখক: শিক্ষার্থী, জামেয়া দরগাহ সিলেট

























