মানব সম্পদ বিনির্মাণে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা

মো: ফরিদ আহমেদ মিয়া
সময় ও প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব যেমন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, তেমনি বদলে যাচ্ছে শিক্ষার ধারণা ও কাঠামোও। বর্তমান যুগে বাস্তবধর্মী, হাতে-কলমে প্রশিক্ষণভিত্তিক শিক্ষা—যাকে আমরা কারিগরি শিক্ষা বলি—তার গুরুত্ব দিন দিন বেড়ে চলেছে। আবার নির্দিষ্ট কাজের ব্যবহারিক জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনের যে শিক্ষা প্রশিক্ষণার্থীদের সহায়তা করে, সেটিই বৃত্তিমূলক শিক্ষা।
বর্তমানে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে জীবিকা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। উভয় শিক্ষাই কর্মমুখী শিক্ষা, যা ব্যক্তিকে বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে সক্ষম করে তোলে। বিপুল জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে কারিগরি শিক্ষা এক শক্তিশালী হাতিয়ার। কারণ, প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা ও কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে অনেক ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থী কর্মজীবনের জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত হতে পারছে না।
অন্যদিকে, কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ব্যক্তি শুধু দেশে নয়, বিদেশেও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি সে আত্মকর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি মানবসম্পদ গঠনের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন পেশাগত ক্ষেত্র যেমন—চিকিৎসা ক্ষেত্রে নার্সিং ও ল্যাব টেকনিশিয়ান, তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রোগ্রামিং ও ডেটা এন্ট্রি, রন্ধনশিল্প, গ্রাফিক ডিজাইন ইত্যাদিতে দক্ষ জনবল তৈরির বিপুল সুযোগ রয়েছে। এসব খাতে প্রশিক্ষিত ব্যক্তিরা বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত থেকে কর্মচঞ্চল জীবন যাপন করে এবং দক্ষতা-ভিত্তিক কর্মসংস্থানে অংশ নিয়ে আয় বৃদ্ধি ও সম্পদ অর্জনে সক্ষম হয়।
কিন্তু বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহের কারণে অনেকেই নিজেদের প্রকৃত যোগ্যতার সঙ্গে অসঙ্গত পেশায় নিযুক্ত হচ্ছে। কেউ শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও হচ্ছে সৈনিক, আবার কেউ চিকিৎসক হওয়ার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পেশা নিচ্ছে আইন ব্যবসা। উদ্দেশ্যহীন শিক্ষা ও কেবল সার্টিফিকেট নির্ভর মানসিকতা জাতিকে দক্ষ পেশাজীবী জনবল থেকে বঞ্চিত করছে।
বর্তমানে দেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৭ শতাংশ, যেখানে জাপানে এই হার ৬০ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪০ শতাংশ এবং মালয়েশিয়ায় ৪২ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য যে, স্বাধীনতার সময় মালয়েশিয়া বাংলাদেশের চেয়ে তেমন উন্নত ছিল না—তাদের মাথাপিছু আয় ছিল আমাদের অর্ধেকেরও কম। অথচ আজ তাদের মাথাপিছু আয় আমাদের চেয়ে প্রায় ১২ থেকে ১৪ গুণ বেশি। এর মূল কারণ, তারা কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার মানদণ্ডে ১৪৯টি দেশের মধ্যে অবস্থান ১১৪তম। দক্ষ ও পরিশ্রমী কারিগরি শিক্ষিত ব্যক্তিরা আত্মনির্ভরশীল হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে এবং উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
অজ্ঞতা ও সামাজিক বৈষম্যের কারণে এখনো অনেকে এই শিক্ষার প্রতি অনীহা পোষণ করে। তবে ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য কারিগরি শিক্ষার প্রসার ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান, আত্মকর্মসংস্থান, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং বেকারত্ব দূরীকরণে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিকল্প নেই।
পরিশেষে বলা যায়, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ছাড়া অধিক জনশক্তিকে প্রকৃত অর্থে জনসম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব নয়।
লেখক: এমএসএস (ইকোনমিক), বিএড
সহকারী শিক্ষক (আইসিটি), কালী প্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়
মুন্সীবাজার, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার।






















