হিজরি নববর্ষ ও মুহাররম; ইতিহাস, ফজিলত ও শিক্ষা

—শিব্বীর বিন রশীদ
বছর ঘুরে আবারও আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে হিজবি নববর্ষ। শুরু হয়েছে ১৪৪৭ হিজরি। আমাদের মনে মহানবি সা. এর ঐতিহাসিক হিজরতের স্মৃতি জাগ্রত রাখার নিমিত্তে হিজরি সনের প্রবর্তন করা হয়। নতুন বছর আসে, পুরনো বছরের স্মৃতি রেখে যায়। কেউ আনন্দ করে, কেউ আফসোস করে হারানো দিনের স্মৃতিকে স্মরণ করে এবং সামনের দিনগুলো যেন সুন্দরভাবে কাটাতে পারি সেই প্রতিজ্ঞা নিয়ে। কিন্তু একজন মুসলমানের জন্য নববর্ষ শুধু একটি নতুন তারিখ নয়—বরং আত্মসমালোচনার এক নূতন অবকাশ, গুনাহমুক্ত জীবনের প্রতিশ্রুতির সময়।
হিজরি সন সূচনার ঐতিহাসিক পটভূমি:
ইসলানি বর্ষপঞ্জিকা তথা হিজরি সনের সূচনা হয় একটি মহান স্মৃতিবাহী ও হৃদয়স্পর্শী ঘটনার ভিত্তিতে, পবিত্র হিজরতের স্মৃতি দিয়ে। হিজরতের ভিত্তিতে বর্ষগণনার এই সিদ্ধান্ত ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা হিজরত কেবল মক্কা থেকে মদিনায় গমন ছিল না, বরং তা ছিল ঈমান ও কুফরের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্যের যুগ, মুসলিম ও কাফেরের মাঝে ধর্ম পালনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের সময়।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, “হিজরত ছিল ইসলামের প্রতিষ্ঠাকালীন একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা, তাই সাহাবাগণ একে বর্ষপঞ্জির সূচনা হিসেবে নির্ধারণ করেন।” —ফতহুল বারী, ৭/২৬৮
মাসিক আল-কাউসারের সম্পাদক মুফতি আবুল হাসান মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল-হিজরি সনের সূচনা কখন কীভাবে হয়েছে?
তিনি উত্তরে বলেন, হজরত উমর রা. তার খিলাফতকালে হিজরতের ১৭তম বর্ষে হিজরি সন গণনা শুরু করেন।
এর প্রেক্ষাপট ছিল এরকম—হজরত উমর রা.-এর কাছে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় চিঠি আসত। সেখানে মাসের নাম ও তারিখ লেখা হত। কিন্তু সনের নাম থাকত না। এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হত। তখন পরামর্শের ভিত্তিতে একটি সন নির্ধারণ ও গণনার সিদ্ধান্ত হয়। বিভিন্ন উপলক্ষ থেকে সন গণনার মতামত আসলেও শেষ পর্যন্ত হিজরতের ঘটনা থেকে সন গণনার সিদ্ধান্ত হয়।
হিজরতের বছর থেকেই সন গণনার তাৎপর্য কী?
এব্যাপারে তিনি বলেন, সন গণনার আলোচনার সময় প্রস্তাব উঠেছিল,ঈসায়ী সনের সূচনার সঙ্গে মিল রেখে নবি কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের সন থেকে ইসলামি সনের শুরু হওয়া। এ রকম আরও কিছু কিছু উপলক্ষের কথাও আলোচিত হয়। কিন্তু হিজরতের সন থেকে সন গণনা চূড়ান্ত হওয়ার পেছনে তাৎপর্য হল, হিজরতকে মূল্যায়ন করা হয় ‘সত্য-মিথ্যার মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী’ বিষয় হিসেবে। হিজরতের পর থেকেই মুসলমানরা প্রকাশ্য ইবাদত ও সমাজ-গঠনের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন। প্রকাশ্যে আজান, নামাজ, জুম’আ, ঈদ সবকিছু হিজরতের পর থেকেই শুরু হয়েছে। এসব তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য করেই মুসলমানদের সন গণনা হিজরত থেকেই শুরু হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
মুহাররম দিয়ে কেন হিজরি সনের সূচনা?
ইসলামিক বা হিজরি অথবা চন্দ্রীয় ক্যালেন্ডারের সূচনা হয় পবিত্র মুহাররাম মাস দিয়ে। একদিকে যখন পাশ্চাত্য সভ্যতা তাদের ইংরেজি নববর্ষের সূচনায় আনন্দ-উল্লাসে মাতোয়ারা হয়, আতশবাজি করে, তখন ইসলাম আমাদের শেখায় নতুন বছরে নিজেকে ঈমানের রঙে সাজানোর পথ । এটি শুধুমাত্র একটি মাস নয়; বরং মুসলিম জীবনের নতুন সনের নব সূচনা, আত্মশুদ্ধি ও অনুশোচনার এক নূতন দিকপাল ।
যদিও হিজরত মুহাররম মাসে ঘটেনি (হিজরত হয়েছিল রবিউল আউয়াল মাসে) তবুও মুহাররম মাস দিয়ে বছর শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যেসব কারণে;
১/ আরবদের রীতি অনুসরণ কর: ইসলামের আগেও আরবরা মহররমকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করত। এই প্রচলিত রীতিকে পরিবর্তন না করে গ্রহণ করা হয়।
২/ হজ শেষে নতুন বছর: ধারণা করা হয় যে, যেহেতু হজ অনুষ্ঠিত হয় জিলহজ্জ মাসে (১২তম মাস), তার পরের মাস অর্থাৎ মহররমকে নতুন বছরের সূচনা হিসেবে ধরলে তা একটি প্রাকৃতিক ধারাবাহিকতা তৈরি করে।
৩/ শান্তির প্রতীক: মহররম মাসকে আল্লাহ তা’আলা “আশহুরুল হুরুম” (পবিত্র মাস) হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন, এই মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। এটি একটি শান্তিপূর্ণ মাস, তাই বছরের শুরু শান্তিপূর্ণভাবে হোক—এমন ভাবনা থেকেও এটি বেছে নেওয়া হয়।
মুহাররমের ফজিলত:
পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এ মাস সম্পর্কে যা এসেছে তা হল, এটা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ মাস। কুরআনের ভাষায় এটি ‘আরবাআতুন হুরুম’-অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম। আয়াতের অর্থ: “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারোটি, এর মধ্যে চারটি পবিত্র (হারাম)।”
এই চারটি মাস হলো: মুহাররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ্জ।
এ মাসে রোজা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদিসে নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমজানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা হল সর্বশ্রেষ্ঠ।’ -সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮
এর মধ্যে আশুরার রোজার ফজিলত আরও বেশি।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ -সহীহ বুখারী ১/২১৮ হযরত আলী রা. কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমজানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’-জামে তিরমিযী ১/১৫৭ অন্য হাদিসে নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ -সহীহ মুসলিম ১/৩৬৭
মুহাররম ও আশুরাকেন্দ্রিক নানা কুসংস্কার:
এ মাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এদিনে আল্লাহ তাআলা তাঁর কুদরত প্রকাশ করেছেন। বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন।-সহীহ বুখারী ১/৪৮১
এ মাসের একটি ঘটনা শাহাদাতে হুসাইন রা.। বলাবাহুল্য যে, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয়। কিন্তু নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই তো শিক্ষা-‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়।’ অন্য হাদিসে নবি কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপরায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে।’
সুতরাং এ মাসে অনৈসলামিক কাজকর্ম যেমন- শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে।
হিজরি নববর্ষে আমাদের কর্তব্য হলো:
১. আত্মপর্যালোচনা করা: নতুন বছরের শুরুতে বিগত জীবনের হিসাব গ্রহণ ও আত্মসমালোচনা করা, আমরা কেমন ছিলাম গত বছর? আমাদেরকে দিনগুলো কীভাবে কেটেছে? আমরা কী পূণ্য অর্জন করতে পেরেছি? গুনাহমুক্ত ছিলাম তো?
২. নেক আমলের অঙ্গীকার করা: নববর্ষ হোক গুনাহ ত্যাগের, নামাজ-রোজা-সদকার নতুন সূচনা।
৩. আশুরার রোজা রাখা: ৯ ও ১০ মুহাররাম অথবা ১০ ও ১১ তারিখ রোজা রাখা সুন্নাত।
৪. জুলুম বিরোধী মানসিকতা তৈরি: কারবালার শিক্ষা গ্রহণ করে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো।
পাশাপাশি নেক আমল করার সংকল্প করতে হবে। আসুন, প্রতিজ্ঞা করি—নিয়মিত নামাজ আদায় করব, কুরআন তিলাওয়াত করব ও উপলব্ধি করব, দান-সদকাহ করব এবং তাওহীদের বার্তা সবার দ্বারে পৌঁছে দিব। নতুন বছরে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করি। আজকের এই দিনের আবেদন হোক: হে আল্লাহ! নতুন বছরটি যেন হয় আমাদের জন্য হেদায়াত, বরকত ও নেক আমলের বছর। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, জামেয়া দরগাহ সিলেট
sibbirrosid@gmail.com

























